আপনাদের নিশ্চয়ই পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে আটক করার কথা মনে আছে। দিনটি ছিল চলতি ২০২১ সালের ১৮ মে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ওই দিন বেলা তিনটা থেকে প্রায় ছয় ঘণ্টা তাঁকে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। ঘটনা এখানেই শেষ ছিল না। পরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় শাহবাগ থানায়। সেখানে প্রায় ১১ ঘণ্টা পুলিশি হেফাজতে রাখা হয়। থানায় তাঁর বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা দেওয়া হয়। এই নামে যে একটি আইন এখনো আছে, মানুষ তা ভুলেই গিয়েছিল। গুদামঘর থেকে খুঁজে বের করে সেই আইনে দেওয়া মামলায় পরদিন তাঁকে পাঠানো হয় কারাগারে। পাঁচ দিন পর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন রোজিনা ইসলাম।
থানায় সোপর্দ করার মধ্যেই কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতি উৎসাহ কমে যায়নি। পরের দিন থেকে রোজিনা ইসলামকে হেয় করতে সর্বশক্তি নিয়ে নেমে পড়েছিল। মন্ত্রণালয়ে আটক থাকার সময়ে অসুস্থবোধ করায় রোজিনা হঠাৎ মাটিতে শুয়ে পড়েছিলেন। এ নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সাংবাদিক নিজেই মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিল’। এই হচ্ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সংবেদনশীলতার নমুনা।
ঘটনার পরের দিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জনগণের করের অর্থ ব্যয় করে রোজিনা ইসলামকে বিষোদ্গার করে বিজ্ঞাপন প্রচার করেছিলেন। সেখানে বলা ছিল, ‘…এতে প্রতীয়মান হয় যে… (এতে প্রমাণিত হয় যে তিনি রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরি করেছিলেন।) ’ অর্থাৎ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপনে কোনো প্রমাণ ছাড়াই রোজিনা ইসলামকে ‘চোর’ বলা হয়েছিল। এ বক্তব্য অবশ্যই মানহানিকর।
প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সেই মামলা প্রত্যাহার হয়নি। হয়রানি এখনো বন্ধ হয়নি। নানাভাবে তাঁকে কাজ করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি পেশাগত কাজে প্রয়োজনীয় অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড। রোজিনা ইসলামের দোষ কী? তিনি নিয়োগ-বাণিজ্যসহ করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি এবং করোনার টিকার বিষয়ে একের পর এক প্রতিবেদন লিখেছিলেন। যার কারণে তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিরা। এমনকি সেসব সংবাদ যে সঠিক ছিল, তা প্রমাণও হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি হয় সরকারি কেনাকাটায়। কেনাকাটা বেশি হয়, এমন খাতের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অন্যতম। আবার করোনাকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেনাকাটা বেড়ে গেছে অনেক বেশি। ফলে দুর্নীতির একটি বড় জায়গা হচ্ছে এই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সন্দেহ নেই এর সঙ্গে জড়িত মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী। রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে নথি চুরির মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সেখানেই সত্যি সত্যি নথি গায়েব হয়ে গেছে। আর এই নথি গায়েবের মামলা তদন্তে নেমে পুলিশের সিআইডি আটক করেছে মন্ত্রণালয়েরই কর্মকর্তা–কর্মচারীদের। ঘটনাটি গত বৃহস্পতিবারের।
একসঙ্গে ১৭ নথি গায়েব। এর মধ্যে কয়েকটি আছে কেনাকাটা–সংক্রান্ত। আর এখন তো জানা যাচ্ছে, নথি গায়েব এই প্রথম নয়। এক মাস আগেও বেশ কয়েকটি নথি গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তারও সুরাহা এখনো হয়নি। খুব বেশি লোককে জানতেও দেওয়া হয়নি। এসব ক্ষেত্রে গোপন রাখার চেষ্টা হয় বলেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ফলে আবার নথি গায়েব।
সত্যিকার নথি গায়েবের পরে অতি উৎসাহী স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিব বা অতিরিক্ত সচিবের অবশ্য কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কোনো বক্তব্যও নিজ থেকে দেননি। মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়নি। মন্ত্রণালয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথি সত্যিকারভাবে গায়েবের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে অর্থ খরচ করে বিজ্ঞাপনও চোখে পড়ছে না। ন্যূনতম স্বচ্ছতা বা জবাবদিহির সামান্য প্রয়োজনও বোধ করছে না তারা। তাদের সব চেষ্টা কেবল দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য প্রচারকারীর বিরুদ্ধে।
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
Leave a Reply