হঠাৎ করেই টেক্সাসের লাবক শহরের রাস্তাঘাটে দেখা যাচ্ছে নামজাদা সব কাল্পনিক সুপারহিরোদের—সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, মিস্টার ইনক্রেডিবল, এলাস্টিগার্ল, ব্যাটম্যান, ক্যাটওম্যানসহ অনেকেই! তাহলে গল্পে, সিনেমায় পৃথিবী ধ্বংসের যে দুর্যোগের কথা বলা হয়, তা কি সত্যি হয়ে গেল! ওয়াল্ট ডিজনির রাজকন্যারাও পথ আলো করে হেঁটে যাচ্ছে একে একে—এলসা, আনা, সিন্ডেরেলা, স্নো হোয়াইট—কে নেই সেখানে! হঠাৎ করে সবাই বুঝি ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতার প্রতিযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বলছি যুক্তরাষ্ট্রে হ্যালোইন উদ্যাপনের কথা। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অক্টোবরজুড়েই পশ্চিমা বিশ্ব মেতে থাকে হ্যালোইনের এমন আমেজে। যদিও ইতিহাসের পাতায় হ্যালোইনের উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। একটি ধারণামতে, হ্যালোইন উদ্যাপিত হয় ‘সন্তদের দিবস’-এর ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ ৩১ অক্টোবর। খ্রিষ্টানরা তাদের মৃত সন্ত এবং আপনজনদের সম্মান জানাতে এই সন্ধ্যা পালন করে। বিকল্প আরেকটি ধারার মতে, ‘কেল্টিক’ নামে পরিচিত ইন্দো-ইউরোপিয়ানদের নবান্ন উৎসবের প্রতিফলক এই হ্যালোইন।
এ সময় বাজারে পাওয়া যায় বাড়ি সাজানোর হরেক উপকরণ—নকল মাকড়সার জাল, প্লাস্টিকের কঙ্কাল, ভৌতিক বিভিন্ন প্রতিকৃতি, মুখোশ আরও কত কী! তবে মিষ্টিকুমড়ার বিভিন্ন সাজসজ্জা ছাড়া যেন হ্যালোইনের সাজ পূরণই হয় না। সব বাসার সামনে অন্তত একটা-দুটো প্রমাণ আকারের মিষ্টিকুমড়া দেখা যাবেই এ সময়। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ভয়ানক মুখের আদলে কাটা মিষ্টিকুমড়ার ভেতর মোমবাতি বা আলো জ্বালিয়ে রাখা, যার নাম জ্যাক-ও’-ল্যান্টার্ন। হ্যালোইনেরও যে একটা রূপকথা আছে, সেটাই বা কজন জানে!
আইরিশ কিংবদন্তি অনুসারে, অনেক শতাব্দী আগে ‘জ্যাক’ নামে এক ভবঘুরে মাতাল ছিল। ভীষণ ধূর্ত ওই লোক ছলচাতুরির মাধ্যমে সবাইকে কষ্ট দিত। একবার শয়তানের ইচ্ছা হলো, জ্যাকের সঙ্গে দেখা করবে। তবে শয়তানও রক্ষা পায়নি জ্যাকের ধূর্ততা থেকে। জ্যাকের ছলচাতুরির শেষ শর্তটি ছিল, শয়তান তার আত্মা নরকে নিয়ে যেতে পারবে না। তাই মৃত্যুর পর অপকর্মের জন্য জ্যাকের যেমন স্বর্গে জায়গা হয় না, তেমনি নরকেও স্থান হয় না। তার আত্মা চিরদিনের জন্য পৃথিবীতে রয়ে যায়। আগেকার আইরিশদের তাই বিশ্বাস ছিল, সবজির একটা টুকরার মধ্যে জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে জ্যাকের আত্মা এখনো পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই অশুভ আত্মা তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আইরিশরা হ্যালোইনের সন্ধ্যায় বিভিন্ন সবজি কিম্ভূতকিমাকার সাজে কেটে তার ভেতর মোম জ্বালিয়ে চারপাশ আলোকিত করত। কালের বিবর্তনে সেই সব সবজির জায়গা দখল করে নেয় মিষ্টিকুমড়া। কারণ, অক্টোবরের শেষের সময়টায় মিষ্টিকুমড়াও ঘরে তোলার সময়। অভিবাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসার পর আইরিশরা এই ঐতিহ্যও সঙ্গে করে নিয়ে আসে। এখন এই ভয়ানক চেহারার মিষ্টিকুমড়া ছাড়া হ্যালোইনের উৎসব কল্পনাই করা যায় না।
ইতিহাস যা–ই বলুক না কেন, আমেরিকান সংস্কৃতি আর হলিউডের প্রভাবেই এই হ্যালোইন এখন বিশ্বের অনেক দেশেই বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করা হয়, ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়িয়ে হাজার মাইল দূরের এশিয়াতেও। মজার ব্যাপার হলো, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া—এসব দেশে আগে থেকেই হ্যালোইনের মতো নিজস্ব কিছু উৎসব রয়েছে। চীনে ‘ক্ষুধার্ত ভূতদের উৎসব’ নামে একটা পার্বণ আছে, যেখানে ভূতদের পানীয়, খাবার অথবা অর্থ উপহার হিসেবে উৎসর্গ করা হয়। সেখানে বৌদ্ধধর্মের অনুসারীরা মন্দিরে প্রার্থনা করার পাশাপাশি কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দেয় এই বিশ্বাস নিয়ে যে নৌকাটি তাদের মৃত আপনজনদের মৃত্যু–পরবর্তী জগতে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। বেশ অদ্ভুত, তাই না! জাপানেও একই ধরনের উৎসবের আয়োজন করা হয়, যেখানে মৃতদের আত্মার শান্তির জন্য রংবেরঙের লন্ঠন জ্বালানো হয়। ভিয়েতনামে এ ধরনের পার্বণ অন্যতম বার্ষিক উৎসব।
হ্যালোইনের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে, বিভিন্ন সাজে নিজেকে সাজানো। দাপ্তরিক কাজেও সেদিনের জন্য যেমন খুশি সাজা উন্মুক্ত। মূল দিবসের দিনে সব শহরেই থাকে বিভিন্ন ধরনের আয়োজন। এবার যেমন দেখার সুযোগ হলো, টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মিউজিকের আয়োজনে মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশনা। প্রথমেই ছিল শিশুদের ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতা। এত এত সাজ, কোনো কার্টুন বা সুপারহিরোর চরিত্রই বাদ পড়েনি সাজ থেকে! এরপর চলল অর্কেস্ট্রার প্রায় ঘণ্টাব্যাপী পরিবেশনা, যার নামটিও ছিল বেশ আকর্ষণীয় ‘স্পুক্টাক্যুলার হন্টসার্ট’। ছদ্মবেশে সাজা গোটা পঞ্চাশেক বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নিয়ে গড়া দলটি যেমন বাজাল সপ্তদশ শতাব্দীর বিটোভেনের ভুবন ভোলানো সুর, তেমনই বাদ গেল না হালের হ্যারি পটার, ফ্রোজেন আর পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ানের সংগীতও।
পড়ন্ত বিকেলে যেন গোটা শহরই বেড়িয়ে পড়ল ট্রিক-অর-ট্রিটের সন্ধানে। হ্যালোইন উদ্যাপনে যদিও ছোট–বড় সবারই সমান অংশগ্রহণ থাকে, কিন্তু শিশুদের কাছে এই দিনের মাহাত্ম্যই যেন অন্য রকম। নানান ঢঙের কিম্ভূতকিমাকার সাজে সেজে, হাতে একটা করে পোটলা অথবা ঝুড়ি নিয়ে বাড়ি বাড়ি চকলেট সংগ্রহ চলে শিশুদের। বিভিন্ন চরিত্রের ঢঙে নিজেদের সাজিয়ে বড়রাও সমানভাবে উৎসাহ দিয়ে যান তাদের! এবার কেউ সেজেছিল দ্য মাস্কের মতো, কেউবা ‘ইট’ সিনেমার ভয়ানক ভাঁড়ের মতো, আবার কেউ কেউ চিরাচরিত ড্রাকুলা। কয়েকজন তো পোষা কুকুরকেও সাজিয়ে গলায় একটা বাক্স ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন! অনেকেই বাড়ির সাজসজ্জায়ও বেশ খরচ করেছেন। একটা বাড়ি তো দেখলাম, রীতিমতো ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছিল, সঙ্গে বিশেষ ভৌতিক আয়োজন! মানুষ লম্বা সারি ধরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল ভৌতিক কাণ্ডকারখানা দেখার জন্য।
দেখতে দেখতেই এবারের হ্যালোইনের বিদায়ঘণ্টা বেজে গেল। গতবার কোভিডের জন্য হওয়া উৎসবের ঘাটতি এবার যেন পুষিয়ে নিয়েছে সবাই। আবারও প্রতীক্ষা সবার, আগামী বছরের হ্যালোইনের জন্য!
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
Leave a Reply