রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক গোলাম সরোয়ার। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর তাঁর ভগ্নিপতি হয়েছেন সেকশন কর্মকর্তা। এক ফুফাতো ভাই স্টোর কর্মকর্তা, আরেকজন গাড়িচালক, ভাতিজিজামাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের সহকারী পরিচালক শিবলী মাহবুবও কম যান না। তাঁর স্ত্রীও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন কর্মকর্তার চাকরি পেয়েছেন। শ্যালক হয়েছেন চিত্রগ্রাহক।
শুধু এই দুই কর্মকর্তাই যে নিজেদের স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন, তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের প্রভাষক রওশন আলমের বড় ভাই, ভাবি, চাচাতো ভাইও সেখানে চাকরি পেয়েছেন।
এই তিনজনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সোহরাব আলী। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজনের এই জোট বেশির ভাগ নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করেন। আত্মীয়স্বজনের বাইরে নিজ নিজ এলাকার মানুষকে অর্থের বিনিময়ে চাকরি দিয়েছেন, এমন অভিযোগও রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে।
অবশ্য রওশন আলমের দাবি, শাহজাদপুর এলাকার অন্য অনেকের মতো তাঁর পরিবারের লোকদেরও চাকরি হয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পর গত ৪ বছরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৫ জন কর্মকর্তা ও ১৪৪ জন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ২০১৫ সালের ৮ মে। ২০১৭-১৮ শিক্ষা বছরে পাঠদান শুরু হয়। মোট শিক্ষার্থী ৩৯৬ জন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এখনো কোনো স্থায়ী ক্যাম্পাস ও অবকাঠামো নির্মিত হয়নি। অস্থায়ী ও ভাড়া করা ভবনে চলছে কার্যক্রম।
বিশ্ববিদ্যালয়টির কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে প্রথমে অস্থায়ী (অ্যাডহক) ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে পছন্দের প্রার্থীর জন্য প্রয়োজনে বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীর বয়স, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত শিথিল করে তাঁদের স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়।
এসব নিয়োগের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন বিশ্বজিৎ ঘোষ। গত জুনে তাঁর মেয়াদ শেষ হয়। বিশ্বজিৎ ঘোষের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ওখানে নেই। এ বিষয়ে কোনো কথা বলব না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক গোলাম সরোয়ারের বাড়ি শাহজাদপুরের ব্রজবালা গ্রামে। এই গ্রামের আবদুল মালেক ও আবদুল মজিদ (অফিস সহায়ক), মোকলেছ (মালি), আবদুল আলিম (বাবুর্চি), মাসুদ (গাড়িচালকের সহকারী), আরিফসহ (চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী) বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে চাকরি করছেন। আবদুল মালেক ও আবদুল আলিম গোলাম সরোয়ারের চাচাতো ও ফুফাতো ভাই। আবদুল মজিদ আত্মীয়। মোকলেছ, আরিফ ও মাসুদ প্রতিবেশী।
ব্রজবালা গ্রামের ২০-২৫ জন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে চাকরি পেয়েছেন। এসব চাকরির ক্ষেত্রে ৮ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক লেনদেন হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে চাকরি পাওয়া ওই গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘এই যুগে টাকাপয়সা ছাড়া চাকরি হয়? কিছু তো লাগে।’
গোলাম সরোয়ারের ভগ্নিপতি বুলবুল আহমেদ চল্লিশোর্ধ্ব। সরকারি চাকরির নিয়োগবিধি অনুযায়ী, নবম ও দশম গ্রেডে চাকরির সর্বোচ্চ বয়স ৩০ বছরের বেশি হওয়া যায় না। জানতে চাইলে বুলবুল আহমেদ দাবি করেন, তিনি সরাসরি নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন।
গোলাম সরোয়ার কেউ নিয়োগবাণিজ্য করতে পারেন না। নিকটাত্মীয় ও
প্রতিবেশীদের চাকরি দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়মশৃঙ্খলা মেনে এসব নিয়োগ দেয়।
সহকারী পরিচালক শিবলী মাহবুব স্ত্রী আসিফা সুলতানা ও শ্যালক হিল্লোল খানের নিয়োগের বিষয়ে বলেন, তাঁদের যোগ্যতা ছিল।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থেকে রেজিস্ট্রার সোহরাব আলী অন্তত ১২ জনকে চাকরি দিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাকাপয়সা নিয়ে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে আপনারা যেমন শোনেন, আমরাও শুনি। তবে কে বা কারা টাকা নেয়, এসব আমরা বলতে পারি না।’ আত্মীয়করণের বিষয়ে তিনি বলেন, ইউজিসি তাঁদের যোগ্য মনে করলে নিয়োগ দিতে বাধা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের রুটিন দায়িত্বে থাকা কোষাধ্যক্ষ (ট্রেজারার) আবদুল লতিফের শ্যালকের ছেলে ইমরান খান সেকশন কর্মকর্তা ও ভাতিজা সুমন পারভেজ অডিট অফিসার পদে কর্মরত। লতিফ বলেন, সুমন পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। ইমরান অনেক দূরের আত্মীয়।
শিরিন আখতার ও ওবায়দুল হক দম্পতি সেকশন কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পেয়েছেন। শিরিন আখতার ইউজিসির জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক রবিউল ইসলামের ছোট বোন। রবিউল দাবি করেন, এসব নিয়োগে তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য দিল আফরোজা বেগম রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনিয়মের খবর তাঁরা শুনেছেন। কিন্তু কোনো অভিযোগ পাননি,পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চাকরি পেয়েছেন আ.লীগ নেতাদের স্বজনেরাও
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের স্বজনেরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে চাকরি পেয়েছেন।
শাহজাদপুরের সাবেক সাংসদ প্রয়াত হাসিবুল রহমানের ভাতিজিজামাই কোরবান আলী ও ভায়রার মেয়ে সাদিয়া জাবিন সেকশন কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পেয়েছেন। শাহজাদপুর উপজেলার চেয়ারম্যান আজাদ রহমানের ছেলে মাহমুদুর রহমান কম্পিউটার অপারেটর কাম অফিস সহায়ক পদে চাকরি করছেন। উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক আশিকুল হকের স্ত্রী জান্নাতুন নাঈম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থানা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সাজেদুল ইসলাম নিরাপত্তা কর্মকর্তা এবং মারুফ হাসান সেকশন কর্মকর্তা। মারুফের স্ত্রী সাদিয়া জেবিনও সেকশন কর্মকর্তা। উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মারুফ হোসেনের ছোট ভাই সোহাগ কম্পিউটার অপারেটর।
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
Leave a Reply