খেলার ছলেই মায়ের ছবিতে হাত বুলিয়ে দেয় আট মাস বয়সী স্পৃহা। ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। মায়ের সঙ্গে মেয়ের এভাবেই হয়তো যোগাযোগ হয়। স্পৃহার বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা তাই স্পৃহার মায়ের ছবিটি ওর কাছাকাছি রাখেন।
বিয়ের ৯ বছর পর গত বছরের ২৮ জুলাই রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে কন্যাশিশুর মা হন লাবণী। শখ করে মেয়ের নাম রাখেন স্পৃহা। পুরো নাম স্পৃহা সানভি কর। সন্তান জন্মের পর করোনায় আক্রান্ত লাবণীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয় তাঁকে। ২ আগস্ট করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে যান তিনি। জন্মের এক সপ্তাহের মধ্যেই মাকে হারায় স্পৃহা।
করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় জন্মের পর মেয়েকে কাছে নিতে পারেননি লাবণী। তাই মা ও মেয়ের কোনো ছবি তোলা হয়ে ওঠেনি। হাসপাতালের নার্স লাবণীর বুকের দুধ সংগ্রহ করে দুই-একবার স্পৃহাকে খাইয়েছিলেন।
রাজধানীর বড় মগবাজারে স্পৃহা এখন হেসেখেলে বড় হচ্ছে। গত শুক্রবার ওদের বাসায় গিয়ে দেখা যায় দিব্যি দিন কাটছে স্পৃহার। পরিবারের সদস্যরা জানালেন, লাল একটি পুতুল ওর সবচেয়ে বেশি প্রিয় খেলনা। স্পৃহা ওর মায়ের স্বভাব পেয়েছে। খিদে একদম সহ্য করতে পারে না, দেখতেও হয়েছে মায়ের মতো। ছোট্ট স্পৃহা বুঝতে পারে না মা তার পাশে নেই।
লাবণীর স্বামী সঞ্জয় করের বড় বোন সুমনা কর মায়ের আদরে বড় করছেন স্পৃহাকে। সুমনা যে বাড়িতে থাকেন, ওই বাড়ির নিচতলাতেই থাকেন স্পৃহার বাবা, দাদা ও দাদি। এখন পিসির ফ্ল্যাটই স্পৃহার নিজের বাড়ি। বাবার ফ্ল্যাটে গেলে সবাই বলেন, স্পৃহা ওর মায়ের বাড়ি গেছে।
স্পৃহার পরিবারের সদস্যরা জানান, মেয়ে কার কাছে থাকবে সে সিদ্ধান্ত লাবণী আইসিইউতে যাওয়ার আগে জানিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, দিদির (সুমনা) কাছেই মেয়ে ভালো থাকবে। তাই এ নিয়ে লাবণীর পরিবারও আর কোনো কথা বলেনি।
এইচএসসি পড়ুয়া একমাত্র মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে সুমনার সংসার। ছোট ভাই সঞ্জয়কে নিজের কাছে রেখে বড় করেছেন সুমনা ও তাঁর স্বামী। বিয়ের পরও সঞ্জয় ও লাবণী সুমনাদের বাসাতেই সংসার পেতেছিলেন। সেখানেই ছিলেন বেশ কয়েক বছর। পরে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে নিচের ফ্ল্যাটে উঠলেও লাবণীর বেশির ভাগ সময় কাটত সুমনাদের বাসায়। সুমনার স্বামী সৌমিত্র সিকদারকে অনেকটা নিজের ভাইয়ের মতো দেখতেন লাবণী। ভাই ফোঁটার আনুষ্ঠানিকতাও পালন করতেন। তাই লাবণীর সন্তান সুমনা করের কাছে বড় হচ্ছে এ নিয়ে কোনো আপত্তি করেননি সৌমিত্র।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান বঙ্গীয় শিল্পকলা চর্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে কাজ করেন সুমনা। সেদিন সকালে স্পৃহাকে আদর করতে করতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওকে হয়তো ওর মায়ের আদর দিতে পারব না, তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। লাবণী মারা গেছে এ শোক বুঝতেও আমাদের সময় লেগেছে। স্পৃহা জন্মেছিল অপরিণত বয়সে ও কম ওজন নিয়ে। আমাদের সবার চিন্তা ছিল যে করেই হোক ওকে সুস্থ রাখতে হবে। দিন চলে যাচ্ছে। তবে আমরা বুঝতে পারছি রাত আর দিন কীভাবে যাচ্ছে। আমাদের সবার জীবনের রুটিন পাল্টে গেছে। অফিসে গেলেও মনে হয় কখন বাসায় ফিরব।’
সুমনা জানান, তিনি অফিসে থাকলে তাঁর বাসার গৃহকর্মী পারভীনই স্পৃহার দেখাশোনা করে।
এইচএসসি পরীক্ষার পরই লাবণীর বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। তবে কোথাও চাকরি করতেন না। লাবণীর স্বামী সঞ্জয় একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। দেশে যখন করোনার প্রকোপ বেশি তখন লাবণীর মা হওয়ার খবরে পরিবারের সবার মধ্যে খুশির সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগও তৈরি হয়। স্পৃহার জন্মের বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই লাবণী ও সঞ্জয় আলাদা ঘরে থাকতেন, যাতে কোনোভাবেই লাবণীর করোনা না হয়।
জানা গেছে, লাবণীর করোনা পজিটিভের রিপোর্ট পেতেও সময় লেগেছিল। শারীরিক অবস্থা খারাপ হলেও রিপোর্টে করোনা নেগেটিভ আসে প্রথমে। পরে অন্য রিপোর্টে আসে পজিটিভ। তখন তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের (সিজার) পরবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ ২০ ঘণ্টা বেশ ভালোভাবেই পার করেছিলেন লাবণী। পরিবারের সদস্যরা ভেবেছিলেন, মেয়েকে নিয়ে সুস্থভাবেই বাড়ি ফিরবেন মা। তবে আইসিইউ, লাইফ সাপোর্ট সব দিয়েও বাঁচানো যায়নি তাঁকে।
সেই সব দিনের কথা ভাবলে এখনো পরিবারের সদস্যরা চোখের পানি আটকে রাখতে পারেন না—লাবণী মারা গেছেন। সঞ্জয়েরও করোনা। সদ্য বাবা হওয়া সঞ্জয় মেয়েকে কোলে নিতে পারছেন না। তখন ভিডিও কলে মেয়েকে দেখে হাউমাউ করে কাঁদতেন সঞ্জয়। স্ত্রীকে হারানোর শোক, স্পৃহাকে ভালো রাখার সংগ্রাম, সব মিলিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে পুরো পরিবারকে।
সঞ্জয় জানালেন, মেয়ের বড় হওয়া উপভোগ করছেন তিনি। স্পৃহা বাইরে বেড়াতে যেতে পছন্দ করে। অফিসে যাওয়ার সময় কান্না করে তাই লুকিয়ে যেতে হয়। এখন বসতে শিখেছে স্পৃহা। স্ত্রীর কথা মনে করে বললেন, মেয়ে মায়ের মতো হয়েছে।
মেয়েকে নিয়ে বাবার গল্প যেন শেষই হতে চায় না। খানিকটা ধরা গলায় বলে যান, ‘আমি তো আমার মেয়েকে ধরতে পারছি, ওর বড় হওয়া দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু লাবণী তো মেয়েকে ধরেও দেখতে পারল না। এসব যখন মনে হয় তখন নিজেকে আর সামলাতে পারি না।’
করোনাকে অবহেলা না করার পরামর্শ দিয়ে সঞ্জয় বলেন, ‘আমরা অনেকেই করোনাকে অবহেলা করি। তবে আমার মতো যাঁরা প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তাঁরাই শুধু করোনার ভয়াবহতা বুঝতে পারবেন। তাই সবাইকে সচেতন হতে হবে। করোনা অনেক কমেছে, তবে মনে রাখতে হবে, এটি এখনো শেষ হয়নি।’
করোনার সময় হলেও অনেকে এগিয়ে এসেছেন পরিবারটির পাশে। সুমনার বাড়িতেই থাকতেন ঝিলিক নামের একজন। বিয়ের পর তিনি অন্য জায়গায় থাকেন। সেখান থেকে সুযোগ পেলেই এসে স্পৃহাকে বুকের দুধ খাইয়ে যান।
সঞ্জয় কথার ফাঁকে প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানালেন। গত বছরের ৫ আগস্ট প্রথম আলোর অনলাইনে ‘মেয়ের নাম স্পৃহা রেখে আইসিইউ থেকে মায়ের চিরবিদায়’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদন পড়ে অচেনা মানুষও স্পৃহার খবর জানার জন্য যোগাযোগ করতেন। প্রথম আলোর সংবাদের সূত্রেই জানতে পেরে এগিয়ে এসেছিলেন অন্য বিভাগে চাকরি করা সঞ্জয়ের সহকর্মী মাহমুদা আক্তার। তিনিও স্পৃহাকে বুকের দুধ দেন। মাহমুদা পাত্রে বুকের দুধ সংগ্রহ করে রাখেন। সঞ্জয় গিয়ে তা নিয়ে আসেন। এভাবেই সবার আদরে বড় হচ্ছে স্পৃহা।
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
Leave a Reply