চট্টগ্রামে কর্মস্থলে শ্রমিক–কর্মচারীদের জন্য কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একের পর এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতে হচ্ছে তাঁদের। ঝুঁকিবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলেছে শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনাও। কাজ করতে গিয়ে চট্টগ্রাম গত দুই বছরেই মারা গেছেন অন্তত ৩৩৮ জন। আর ১০ বছরে নিহত হয়েছেন অন্তত ৭৭১ জন।
সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) নামের দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠান দুটি কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। তারা কর্মস্থলে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের তালিকা সংরক্ষণ করে। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও স্থানীয় উৎস থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করে থাকে দুই প্রতিষ্ঠান।
কর্মস্থলে ন্যূনতম নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা, অতিরিক্ত মুনাফার আশা এবং মালিকপক্ষের শ্রমিকদের সুরক্ষা নিয়ে গাফিলতির কারণে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানান বিশেষজ্ঞ ও শ্রমিকনেতারা।
২ বছরেই মৃত্যু ৩৩৮ জনের
দুই প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নির্মাণকাজের সময় ২০১৩ থেকে ২০২০ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছিল ৪০৮ জনের। আর গত দুই বছরেই মারা গেছেন ৩৩৮ জন। এর মধ্যে গত বছরের ৪ জুন সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যু হয় ৫০ জনের।
গত বছরে (২০২২) কর্মস্থলে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ৫০ জন, পরিবহন খাতে ৪৯ জন, নির্মাণ খাতে ৩৫ জন, জাহাজ ভাঙা কারখানায় ৭ জন, চা খাতে ৮, পোশাক কারখানায় ৮, সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে ১২ জন, কৃষক ১৩ এবং ৯ পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া দিনমজুর, বিদ্যুৎকর্মী, কলকারখানা, গৃহপরিচারিকাসহ আরও ৪৬ জন নিহত হয়েছিলেন।
নিহতদের মধ্যে জাহাজ ভাঙা, নির্মাণ খাত, পরিবহন, পোশাকশ্রমিক, দিনমজুরসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার শ্রমিক আছেন। কর্মক্ষেত্রে ন্যূনতম নিরাপত্তার ব্যবস্থা পূরণ করা হলে অনেক প্রাণ বেঁচে যেত।
চট্টগ্রামের কারখানাগুলোয় কর্মীদের যে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নেই, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানেও। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গত দুই মাসে চট্টগ্রামের তিনটি কনটেইনার ডিপো, তৈরি পোশাক কারখানা, কয়লার ডিপোসহ ৯টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করেন। একটি প্রতিষ্ঠানেও ন্যূনতম কর্মসহায়ক পরিবেশ, অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা/// পাওয়া যায়নি। এসব কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তত ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। আর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল একজন।
তবে এসব অভিযান আর জরিমানা যে কাজে আসছে না, তা বোঝা গেছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের বিস্ফোরণের ঘটনায়। এই ঘটনায় সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ২৪ জন। যে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, তাতে আরও বেশি প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু কারখানাটির দুই পাশে অবস্থিত দুটি কারখানার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় প্রাণহানির পরিমাণ কম হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানের কর্মীরা। বিস্ফোরণে সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের আরেকটি কারখানা এবং পাশের এইচ স্টিল রিরোলিং লিমিটেড ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের গাফিলতি ছিল বলে মনে করছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কারখানাগুলোয় যাতে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়, সে জন্য করণীয় নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলছে। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ রেখে কারখানাগুলো চলতে পারে না।
মুনাফার লোভে নিরাপত্তায় ঘাটতি
বিশেষজ্ঞ, শ্রমিক, কর্মচারী ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) কর্মকর্তারা জানান, কর্মক্ষেত্রে কাজের সহায়ক পরিবেশের অভাব, শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকা, নির্মাণাধীন স্থাপনায় যথাযথ নিরাপত্তা বেষ্টনী না দেওয়া এবং সরকারি সংস্থাগুলোর নিয়মিত তদারকের ঘাটতির কারণে বন্দর নগর চট্টগ্রামে বারবার ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে। অতিরিক্ত মুনাফা করতে গিয়ে শ্রমিক–কর্মচারীদের নিরাপত্তার বিষয়টিতে নজর দেয়নি মালিকপক্ষ।
তাঁরা বলছেন, এসব মৃত্যুর ঘটনায় গাফিলতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুব একটা নেই। কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে কর্মস্থলে নিরাপদ ও সুরক্ষামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের বা ব্যক্তির অবহেলা কমছে না।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের (টিইউসি) চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি তপন দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, কারখানাগুলোয় শ্রমিকদের জন্য কোনো নিরাপত্তা বা সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ এসব বিষয় দেখার জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ একাধিক সরকারি সংস্থা রয়েছে। কিন্তু কারখানাগুলো আদৌ নিয়ম মেনে চলে কি না, তা নিশ্চিত করতে এসব সংস্থা তেমন কোনো উদ্যোগ নেয় না। কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটলে সবাই নড়েচড়ে বসে। এরপর ধীরে ধীরে তা নিয়ে আর আলোচনা হয় না। এ ছাড়া শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যে টাকা বিনিয়োগের প্রয়োজন, বাড়তি মুনাফার আশায় মালিকপক্ষ তা করে না। আবার দুর্ঘটনার গাফিলতির দায়ও তাঁদের নিতে হয় না।
তবে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মিনা মাসুদ উজ্জামান দাবি করেছেন, শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কারখানাগুলো নিয়মিত নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে জনবলের অভাব রয়েছে। তাই প্রতি মাসে কারখানাগুলো পরিদর্শন করা সম্ভব হয় না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত খান প্রথম আলোকে বলেন, কারখানাগুলোয় নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে বেশি নজর দেওয়া দরকার। বিশেষ করে রাসায়নিকসহ যেসব প্রসেস ইন্ডাস্ট্রি (প্রক্রিয়াজাত শিল্প) রয়েছে, সেখানে দুর্ঘটনা ঘটে বেশি। অনেক কারখানার প্রয়োজনীয় সনদ থাকলেও দক্ষ জনবলের ঘাটতি থাকে। আবার নিয়মিত তদারকও করা হয় না। তদারককারী সংস্থাগুলোর নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টি কারখানার পরিচালনাকারীদের ওপর চাপিয়ে দিতে হবে। ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া গেলেই দুর্ঘটনা কমে আসবে।
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
Leave a Reply