দৈনিক মৌলভীবাজার সোনালী কণ্ঠ নিউজ ডট কম
ডিজিটাল দুনিয়ায় ই-কমার্স এগোচ্ছে, এ কথা কেউই অস্বীকার করবেন না। কিন্তু আপনার জানা উচিত ই-কমার্স নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আইন নেই দেশে। বেশি দামের পণ্য কম দামে কেনার সিদ্ধান্ত বা ঝুঁকি তো আপনি নিলেন। কেউ অফার দিল আর আপনিও লুফে নিলেন। একবারও ভাবলেন না, দামি জিনিস অর্ধেক দামে বিক্রি করা হচ্ছে কীভাবে?
ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনায় বর্তমানে ‘জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা’ নামে শুধু একটা নীতিমালা আছে দেশে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই নীতিমালা প্রণয়ন করে ২০১৮ সালে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ২০২০ সালে একবার তা সংশোধনও করা হয়। যদিও সংশোধনের পর এ খাতে কোনো বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি।
কম দামে পণ্য কেনার আগে নীতিমালাটিও একটু পড়ে নিন। দেখে নিন, আপনার স্বার্থ সুরক্ষার খুব ভালো রক্ষাকবচ এই নীতিমালা কি না। জি, নীতিমালাটিকে অসম্পূর্ণ বলেই বিবেচনা করা হয় প্রায় সব মহল থেকে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুনে একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। এতে উঠে আসে নানা অসংগতি। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত মাসে নতুন করে প্রণয়ন করে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা। ব্যস, এটুকুই।
যদিও দণ্ডবিধি ১৮৬০ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আইন, ২০০৯ অনুযায়ী অগ্রিম মূল্য নেওয়ার পর সময়মতো পণ্য সরবরাহ না করা অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ ও প্রতারণা। শাস্তি এক থেকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। নিজেই ভাবুন, প্রতারিত হলেও কেউ কি মামলা করার পথে গিয়েছেন বা যাচ্ছেন? পণ্য কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ইংরেজিতে লেখা চার পৃষ্ঠার শর্তগুলোও একবার পড়ে দেখেছেন? মামলার পথে যেতে না চাওয়ার বিষয়টা অনুমেয়। অন্যতম কারণ কোর্ট–কাছারি, শুনানি, রায়, অর্থাৎ নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রতা।
সংগত কারণেই ই-কমার্সের বাজার বড় হচ্ছে। করোনাকালে ই-কমার্স ব্যবসার দ্রুত বিস্তার ঘটার বাস্তবতাও স্বাভাবিক। ই-কমার্সের প্রসারটা হলো কেন? কারণ, মানুষের পণ্য দরকার, কিন্তু আপনি বাজারের ভিড়ের মধ্যে যাবেন না। ভিড়ও বড় কথা নয়, বাজারে যাওয়ার সময়ই নেই আপনার। ফলে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ক্রয়াদেশ দেবেন, লোক মারফত আপনার বাসায় পণ্য পৌঁছে যাবে। ক্রয়াদেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড বা মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের (এমএফএস) মাধ্যমেও টাকা পরিশোধ করে দিতে পারেন। আবার নগদেও পণ্য সরবরাহকারী বা ডেলিভারি ম্যানের হাতেও দিতে পারেন। তবে বিশ্বজুড়ে কার্ডেই ই-কমার্সের লেনদেন বেশি হয়।
ঘরের দুয়ারে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই ই-কমার্সের যাত্রা শুরু। সংজ্ঞার কথা যদি বলা হয়, ইলেকট্রনিক নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেট ব্যবহার করে পণ্য বেচাকেনা, অর্থ লেনদেন ও তথ্য আদান-প্রদানই হচ্ছে ই-কমার্স বা ই-বাণিজ্য। সাধারণত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ভোক্তার (বিটুসি) মধ্যে এই বাণিজ্য হয়। কিন্তু বিষয়টা এখন বিশ্বের কোথাও ছোট আকারে থেমে নেই, এমনকি বাংলাদেশেও নয়। এখন এক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও আরেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের (বিটুবি) মধ্যে এবং ভোক্তা ও ভোক্তার (সিটুসি) মধ্যেও ই-বাণিজ্য হয়।
বাংলাদেশে ই-কমার্স যাত্রা শুরু করে ২০০৫ সালে ক্লিকবিডির মাধ্যমে এবং এ ধারা জনপ্রিয় হতে শুরু করে ২০১৪ সালের পর থেকে। কিছু সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও দারাজ বাংলাদেশ, চালডাল, ইভ্যালি, ক্লিকবিডি, পিকাবু, আজকের ডিল, রকমারি, বাগডুম, অথবা, প্রিয়শপ, বিক্রয় ডটকম, ফুডপান্ডা ইত্যাদি এখন জনপ্রিয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান।
করোনার সংক্রমণ শুরুর পর থেকে একশ্রেণির গ্রাহক ঘরে বসে পণ্যের ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন, পণ্য পাচ্ছেনও। কিন্তু পাশাপাশি বাড়তে থাকে কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বহুমাত্রিক অভিযোগ। একধরনের পণ্য দেখিয়ে অন্য ধরনের পণ্য দেওয়া, নকল বা মানহীন পণ্য দেওয়া, যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ না করা, পণ্য না দিলেও টাকা ফেরত না দেওয়া বা দেরিতে দেওয়া ইত্যাদি হচ্ছে গ্রাহকদের দিক থেকে প্রধান অভিযোগ।
তাহলে গ্রাহক হিসেবে আপনার দায়টা কোথায়, একবারও খেয়াল করেছেন?
নিত্যপণ্যের পাশাপাশি এখন টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর ইত্যাদি ইলেকট্রনিক পণ্য, দামি গাড়িও কেনাবেচা হচ্ছে ই-কমার্সে। আপনি ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, প্রতারিত হলে অভিযোগ জানানোর একটা জায়গা আছে। সেটা হচ্ছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দুই পক্ষকে ডেকে সালিস করে।
অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে জরিমানা করা হয়। সর্বোচ্চ জরিমানা দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। দণ্ডিত ব্যক্তি আবার একই ধরনের অপরাধ করলে দ্বিগুণ জরিমানা করার বিধানও আছে। মোট জরিমানার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী পান। কখনো কখনো নোটিশ পাওয়ার পরও গ্রাহককে পণ্য বুঝিয়ে দেয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছর ৩০ জুন পর্যন্ত ভোক্তা অধিকার ১৩ হাজার ৩১৭টি অভিযোগ পেয়েছে, যার মধ্যে ৮ হাজার ৯০৪টি অভিযোগই বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
সেদিন এক ব্যাংকার বন্ধু ফোন দিল। জানাল, একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে মোটরবাইক কেনার জন্য অগ্রিম এক লাখ টাকা জমা দিয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মোটরসাইকেল পায়নি।
নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর কেটে গেল আরও তিন মাস। ফোন দিলেও কেউ ধরে না। খুদে বার্তা দিয়ে প্রতিষ্ঠান খালি ধৈর্য ধরতে বলে। এতে সে ক্ষুব্ধ। তাঁর প্রশ্ন, সরকার এসবের কিছুই দেখছে না কেন? সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করবে। কিন্তু প্রতিকার চাইতে কোনো মামলা করবে না। কারণ, মামলার পেছনে দৌড়ানোর সময় নেই তাঁর।
প্রথমেই ভাবা উচিত, যে প্রতিষ্ঠানকে আপনি টাকা দিলেন, সে প্রতিষ্ঠান পণ্য না দিলে আপনার কী করার আছে? ওই যে বললাম, অভিযোগ জানাতে পারেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে। তাতে কাজ হতেও পারে। লড়ার শক্তি ও ধৈর্য থাকলে প্রতারণার দায়ে মামলাও করতে পারেন। কিছুই না পারলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষোভও ঝাড়তে পারেন। কিন্তু কোনো পথেই না গিয়ে খালি খালি সরকারকে দোষারোপ করতে যাবেন কেন? সরকারের কোনো দপ্তর নিশ্চয়ই এমন আশ্বাস দেয়নি যে দুই লাখ টাকার জিনিস এক লাখ টাকায় না পেলে এর দায়দায়িত্ব সরকার নেবে। তাহলে? নিজের দায়িত্বটুকু আগে পালন করুন, তারপর সরকারকে দোষারোপ করুন।
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
Leave a Reply