কুমিল্লার লালমাই ফুটওয়্যার বছরে ১০০ কোটি টাকার বেশি জুতা রপ্তানি করে। ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কিছু নামীদামি ব্র্যান্ডের জুতা তৈরি হচ্ছে কুমিল্লা শহরের অদূরে ধনপুরে অবস্থিত লালমাইয়ের কারখানায়। কুমিল্লার শহরতলির কারখানায় বিশ্বখ্যাত যেসব ব্র্যান্ডের জুতা তৈরি হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রাঙ্কোসার্টো ও ন্যাচারালাইজার, জার্মানির লিডেল, ইতালির চিকো, স্পেনের ডাস্টিন টিজাস, ফ্রান্সের ডামার্ট ও অ্যারাম ইত্যাদি। এ ছাড়া জেসিপেনি, এবিসি মার্ট, ম্যাসিস, কোলসের মতো বিশ্বখ্যাত মেগাশপেও কুমিল্লার লালমাই ফুটওয়ারের জুতা পাওয়া যায়।
লালমাই ফুটওয়্যার শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান। নারী-পুরুষ ও শিশু—সবার জুতা বানায় প্রতিষ্ঠানটি। এটির কারখানায় প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার জোড়া জুতা বানানোর সক্ষমতা আছে। লালমাইয়ের কারখানায় মাত্র এক পালায় কাজ হয়। অর্থাৎ মাত্র আট ঘণ্টায় পাঁচ হাজার জোড়া জুতা বানানোর সক্ষমতা রয়েছে লালমাই ফুটওয়্যারের।
শতভাগ রপ্তানিমুখী জুতা তৈরির প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লালমাই ফুটওয়্যার দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান। কুমিল্লার স্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত লালমাই গ্রুপেরই প্রতিষ্ঠান লালমাই ফুটওয়্যার। প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানির ৯০ শতাংশের বেশি চামড়ার জুতা। আর বাকি ২০ শতাংশ জুতা পাটজাত পণ্য থেকে তৈরি হয়।
কুমিল্লা শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ধনপুর গ্রামে প্রায় ৩০ বিঘা জমির ওপর সবুজের মধ্যে লালমাই ফুটওয়্যারের কারখানা। ৩০ বিঘা জমির মাত্র ১০ বিঘায় আছে কয়েকটি কারখানা ভবন। বাকি জমি গাছপালায় ভরা। কারখানার অভ্যন্তরে আছে বিশাল এক পুকুরও। ১৯৯২ সালে এই কারখানার যাত্রা শুরু হয়। গত তিন দশকের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে জুতা রপ্তানিতে প্রথম সারির একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এটি। কয়েক বছর ধরে চামড়া খাতে দেশের শীর্ষ তিন করদাতা প্রতিষ্ঠানের একটি লালমাই ফুটওয়্যার।
প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জুতার মানে কখনো ছাড় দিই না। প্রায় তিন দশক ধরে বিদেশি ক্রেতারাও আমাদের ওপর আস্থা রেখেছেন। বিশ্বের খ্যাতনামা অনেক ব্র্যান্ডের জুতা আমরা তৈরি করি। এটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের।’
সম্প্রতি সরেজমিনে কারখানায় দেখা যায়, জার্মানির লিডেল ও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাচারালাইজার ব্র্যান্ডের জুতা তৈরি করা হচ্ছে। পুরো কারখানায় সব মিলিয়ে চারটি ইউনিটের কাজ চলে। প্রথম ইউনিটে জুতার তলা বা সোল তৈরি হয়। মূল কারখানার পাশে আরেকটি ভবনে মণ্ড থেকে ডাইসের মাধ্যমে সোল তৈরি করছেন ৬০-৭০ জন কর্মী। হাই হিল, শু, স্যান্ডেল—সব ধরনের জুতারই সোল বানানো হয় সেখানে। এ ছাড়া আছে জুতার আপার কাটিং ইউনিট। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, হরেক রকম মেশিনে বিভিন্ন আকারের জুতার ওপরের চামড়ার অংশ কাটা হচ্ছে। পাশাপাশি জুতার সুকতলা তৈরি করে সেখানে বৈশ্বিক বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ছাপ বা নাম বসানো হচ্ছে। প্রায় ২০০ জনের বেশি কর্মী এ ইউনিটে কাজ করেন। ভবনের তিন ও চারতলায় সেলাই বিভাগ। বিভিন্ন আকারের চামড়া এই ইউনিটে মেশিনের সাহায্যে সেলাই করা হয়। সেলাইয়ের পর জুতা তৈরির সর্বশেষ ধাপে রয়েছে লাস্টিং অ্যান্ড ফিনিশিং ইউনিট।
এ ইউনিটের এক পাশে একেক মেশিনের সারি। ওই সারিবদ্ধ মেশিনের এক পাশে জুতার সোল দেওয়া হয়। এরপর কিছুটা এগোনোর পর যুক্ত করা হয় জুতার সুকতলা। এর পরের ধাপে যুক্ত করা হয় জুতার ওপরের চামড়ার অংশ। সর্বশেষ ধাপে জুতা ঠিকমতো তৈরি হলো কি না, পরীক্ষা করা হয়। এভাবেই তৈরি হচ্ছে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের একেকটি জুতা। পরে তৈরি হওয়া জুতা প্যাকেটজাত করে ক্রেতার নির্দেশিত মান যাচাইয়ে প্যাকেটসহ স্ক্যানার মেশিনে দেওয়া হয়। সেখানেই লিডেল বা ন্যাচারালাইজার ব্র্যান্ডের জুতার বিদেশে যাওয়ার সবুজ সংকেত মেলে।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, দেশে জুতা তৈরির শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের পর লালমাই ফুটওয়্যারের দৈনিক জুতা বানানোর সক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। বাচ্চাদের জুতার জন্য বিখ্যাত ইতালির ব্র্যান্ড চিকোর জুতা বানানো হয় লালমাইয়ের কারখানায়। প্রতিষ্ঠানটির তৈরি বাচ্চাদের জুতা ইউরোপের শোরুমে প্রতি জোড়া ৬৫ থেকে ১২০ ইউরোতে বিক্রি হয়। ফ্রান্সের ডামার্ট জনপ্রিয় নারীদের জুতার জন্য। তারা লালমাই থেকে নেওয়া প্রতি জোড়া জুতার ৮০ থেকে ১২০ ইউরোতে বিক্রি করে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রাঙ্কোসার্টো ব্র্যান্ডের বুট জুতার দাম ৭৫ ডলার থেকে ১৮০ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাচারালাইজার ব্র্যান্ডের জুতার দাম ১০০ ডলারের বেশি। আর জার্মানির লিডেলের জুতাও ৭০-৮০ ইউরোর কমে বিক্রি হয় না। এসব দামি জুতা এ দেশের শ্রমিকের হাতে তৈরি।
কয়েক বছর ধরেই লালমাই ফুটওয়্যার ১০০ কোটি টাকার বেশি সমমূল্যের জুতা রপ্তানি করছে। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১২৪ কোটি টাকার সমমূল্যের জুতা। পরের বছর রপ্তানি হয় ১২১ কোটি টাকার জুতা। করোনার ঠিক আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালে ১২৫ কোটি টাকার জুতা ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি হয়। তবে ২০২০ সালে করোনার
কারণে রপ্তানি কমে নেমে এসেছিল ৯২ কোটি টাকায়।
লালমাই ফুটওয়্যারে বর্তমানে সব মিলিয়ে ১ হাজার ৩২৫ জন কর্মী কাজ করেন। তাঁদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই নারী। সব কর্মীর দুপুরের খাবার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া নারী কর্মীদের জন্য আছে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র। আর একটি চিকিৎসা কেন্দ্র আছে, যেখানে সার্বক্ষণিক একজন চিকিৎসক থাকেন। করোনার মধ্যে লালমাই ফুটওয়্যার একজন কর্মীও ছাঁটাই করেনি। কারখানা দুই মাস বন্ধ থাকলেও কর্মীরা নিয়মিত বেতন-ভাতা পেয়েছেন।
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
Leave a Reply