মোশারফ হোসেনের বয়স যখন তিন বছর, তখন মারা যান বাবা। চার বোন ও এক ভাইকে নিয়ে মা যেন অথই সাগরে পড়লেন। সেই থেকে চরম দারিদ্র্যই যেন তাঁদের নিত্যসঙ্গী। দুমুঠো ভাতের জন্য মানুষের কাছে হাতও পাততে হয়েছে। অর্থকষ্টে দিতে পারেননি এসএসসি পরীক্ষা। দুই দশক আগে জীবিকার প্রয়োজনে এক মামার হাত ধরে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। বঙ্গবাজারের একটি কাপড়ের দোকানে কাজ নেন। বেতন মাত্র ১ হাজার ৮০০ টাকা।
দুই দশক ধরে দোকানকর্মীর কাজ করা মোশারফ হোসেনের বয়স এখন ৩৭ বছর। মাত্র ৮ মাস আগে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে তিনি বঙ্গবাজারে ব্যবসা শুরু করেন। বেচাবিক্রিও ভালো ছিল। ঈদ কেন্দ্র করে স্বজন ও বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে প্রায় ২০ লাখ টাকার মালামাল তোলেন তিনি। ভেবেছিলেন, এবার হয়তো কষ্টের দিন শেষে সুদিন ফিরবে। কিন্তু হঠাৎ আগুনে দোকানের সব মালপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
আজ শনিবার দুপুরে আগুনে পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজারের ধ্বংসস্তূপে নিজের দোকানটি যেদিকে ছিল, সেদিকে একপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন মোশারফ হোসেন। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই কান্না জুড়ে দেন তিনি।
মোশারফ হোসেন বলেন, ‘ভাই, এত কষ্ট করেছি জীবনে, কল্পনা করতে পারবেন না। তবু থেমে যাইনি কখনো। দুই দশকের চেষ্টায় নিজের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছি। খুব হিসাব করে করে ব্যবসাটা বড় করছিলাম। একটি টাকাও এদিক-সেদিক খরচ করতাম না। খরচ বাঁচাতে মা, স্ত্রী ও তিন সন্তানকেও ঢাকায় নিয়ে আসিনি। আমি থাকি নাজিরাবাজারে একটি মেসে। ভেবেছিলাম, এবার হয়তো সুদিন ফিরবে। কিন্তু সুদিন আর ফিরল না। উল্টো এখন এমন বিপদে পড়েছি, সামনে শুধু অন্ধকার দেখছি। ধার পরিশোধ করব কীভাবে, সেই চিন্তায় এখন ঘুমও আসছে না।’
আগুনে দোকানের মালপত্রের সঙ্গে চার লাখ টাকা পুড়ে ছাই হয়েছে বলে দাবি করেন মোশারফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘মেসে টাকা রাখা নিরাপদ নয়, এ কারণে বেচাবিক্রির সব টাকাও দোকানেই রাখতাম। আগের দিন রাতে (আগুন লাগার আগের রাত) দোকানে চার লাখ টাকা রেখে গিয়েছি। পকেটে মাত্র ২২ টাকা নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়েছিলাম। কারণ, দোকান থেকে মেস হাঁটা দূরত্বে। টাকার প্রয়োজন হলে তো দোকান থেকেই নেওয়া যাবে। এভাবে সব শেষ হয়ে যাবে, ভাবতেই পারিনি। ধ্বংসস্তূপ সরানোর পর অস্থায়ীভাবে চৌকি পেতে বসে ব্যবসা করার মতো অবস্থাও আমার নেই। মা, স্ত্রী-সন্তানকে ঈদে সামান্য টাকা পাঠানোর সামর্থ্যও নেই আমার।’
মোশারফ হোসেনের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের উবারামপুর গ্রামে। তাঁর বাবা আবিদুর রহমান ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। চার বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট।
মোশারফ হোসেনের ভাষ্য, গ্রামে ভিটেবাড়ি ছাড়া তাঁদের আর কোনো সম্পদ নেই। বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তাঁদের সচ্ছলতা ছিল বলে শুনেছেন। তবে বাবার মৃত্যুর পর পরিস্থিতি বদলে যায়। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটে তাঁদের। বাবা বেঁচে থাকতে দুই বোনের বিয়ে হয়েছিল। আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় এক বোনের বিয়ে হয়। তিনি দোকানকর্মীর কাজ নেওয়ার পর আরেক বোনের বিয়ে হয়। মোশারফ বিয়ে করেছেন ১০ বছর আগে।
গত মঙ্গলবার সকালে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগে। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের কয়েকটি বিপণিবিতানে। সাড়ে ছয় ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও বুধবার অ্যানেক্সকো টাওয়ারে থেমে থেমে ধোঁয়া ও আগুন জ্বলে। গত বৃহস্পতিবার বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের কিছু জায়গা থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। গতকাল শুক্রবার সকালে আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয় বলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
মোশারফ হোসেনের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী এসে বলেন, ‘ভাই, আমাদের কথাও একটু শোনেন, আমাদের কথাও লেখেন। বড় বিপদে আছি। সব শেষ হয়ে গেছে।’
Leave a Reply