কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ‘চাকিরপশার’ বিল কোনো ব্যক্তি বা সমিতির অনুকূলে ইজারা ও বন্দোবস্ত দেওয়ার ওপর তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন হাইকোর্ট। ২৮৩ দশমিক ২৮ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত চাকিরপশার বিলটি স্থানীয়ভাবে নদী হিসেবেও পরিচিত।
এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ শওকত আলী চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ সোমবার রুলসহ এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে বিলটিতে থাকা অননুমোদিত সব দখলদারকে দুই মাসের মধ্যে উচ্ছেদ করতে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া চাকিরপশার বিলের ১৪১ দশমিক ২৯ একর জমি ‘চকিরপশার মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিডেট’ নামের সমিতি বরাবর ইজারার বিষয়ে নেওয়া ব্যবস্থা সম্পর্কে রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার ও কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসককে আদালতে প্রতিবেদন দিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) গত মাসে ওই রিট করে। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও মিনহাজুল হক চৌধুরী। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী এস হাসানুল বান্না।
বেলা জানায়, চাকিরপশার বিলটি রাজারহাট উপজেলার রাজারহাট, চাকিরপশা ও বিদ্যানন্দ ইউনিয়ন দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উলিপুর উপজেলায় গিয়ে তিস্তা নদীতে মিলিত হয়েছে। মূলত এটি তিস্তা নদীর একটি উপনদী হিসেবে স্থানীয়ভাবে পরিচিত। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী উজানে বিলটির দৈর্ঘ্য ১৮-২০ কিলোমিটার এবং ভাটি অংশে ১৬ কিলোমিটার।
বেলা বলছে, বিলটি নদীর সঙ্গে যুক্ত হলেও এটি বদ্ধ জলমহাল হিসেবে চাকিরপশার মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড নামে একটি সমিতির অনুকূলে তিন বছর মেয়াদে ইজারা দেওয়া হয়। এ নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে গ্রামবাসী আপত্তি জানিয়ে আসছে।
জনগুরুত্বপূর্ণ বিলটির পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে আড়াআড়িভাবে বাঁধ নির্মাণ ও দখলের ফলে বিল ও বিল সংলগ্ন প্রায় ২০ হাজার একর জমিতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে ফসলের উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। এর জেরে অন্তত পাঁচ হাজার কৃষক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিলটির নানামুখী অব্যবস্থাপনা এবং বিলটি যথাযথ সংরক্ষণে স্থানীয় বাসিন্দাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রিটটি করা হয়।
রুলে অননুমোদিত দখল, বন্দোবস্ত ও ত্রুটিপূর্ণ ইজারা দেওয়া থেকে বিলটি রক্ষায় বিবাদীদের ব্যর্থতাকে কেন অসাংবিধানিক ও আইনবহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। সিএস ম্যাপ অনুযায়ী বিলের সীমানা নির্ধারণ করে অবৈধ সব স্থাপনা ও দখলদার উচ্ছেদ এবং বিলের ‘পাঠানহাট’ স্থানে নির্মিত আড়াআড়ি বাঁধ অপসারণ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে বিল ও বিলের স্বাভাবিক প্রবাহ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা-ও রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া বিলটি বেআইনিভাবে ইজারা ও বন্দোবস্তের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, সে বিষয়েও রুল হয়েছে। পানিসম্পদসচিব, পরিবেশসচিব, ভূমিসচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসচিব, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক, ভূমি জরিপ ও রেকর্ড অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী, রংপুর বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার, কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার এবং চাকিরপশার মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতিসহ তিন মাসের মধ্যে বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
বিলটি নিয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কয়েক দফা সুপারিশ করেছে। সুপারিশ অনুযায়ী, চাকিরপশার বিলটি সিএস মৌজা ম্যাপ অনুযায়ী দখলমুক্ত করে সংরক্ষণ এবং রেকর্ড সংশোধন করে উন্মুক্ত জলাশয়ে রূপান্তর করতে হবে; পাঠানহাট নামের স্থানে বিলের প্রবাহ বন্ধ করে এলজিইডি কর্তৃক আড়াআড়ি নির্মিত রাস্তা জরুরি ভিত্তিতে অপসারণ করে ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে; অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে; বিলের পানিনিষ্কাশন, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় এবং বৃষ্টি ও বন্যার পানির প্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিল বা নিচু ধরনের জমির শ্রেণি সিএস অনুযায়ী অপরিবর্তিত রাখতে হবে; বিলের ইজারা বাতিল করে এটি উন্মুক্ত জলাশয় হিসেবে ঘোষণা করতে হবে; বিলকে মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা করতে হবে; তীরভূমিতে ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও বৃক্ষরোপণ করে পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করতে হবে এবং জলাশয়কে ঘিরে পর্যটনশিল্প গড়ে তুলতে হবে।
Leave a Reply