বিশ্বব্যাংক ১৯৬০ সাল থেকে মাসভিত্তিক পণ্যমূল্যের রেকর্ড সংরক্ষণ করে আসছে। এই ৬৩ বছরে পাম তেল, সয়াবিন তেল, গম কিংবা সয়াবিন বীজের সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড হয় গত বছর। রেকর্ডের সময়কাল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর মার্চ থেকে জুন মাসের মধ্যে। অর্থাৎ ৭৫৬ মাসে কোনোটির সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড হয়েছে ২০২২ সালের মার্চে, কোনোটির জুনে। আর সর্বোচ্চ দামে পণ্য কিনে এমন অস্বস্তির সময় পার করেছে বাংলাদেশও।
পণ্যমূল্যের দামে রেকর্ড ভাঙার সময় পেরিয়ে গেছে। নতুন বছর তথা ২০২৩ সালে অনেকটা স্বস্তি দিয়েই শুরু হয়েছে। এ স্বস্তি হলো বিশ্ববাজার থেকে এখন আর রেকর্ড দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে না।
তাতে অর্থনৈতিক সংকটের এই সময়ে ভোগ্যপণ্য আমদানিতেও ডলার খরচ কমতে শুরু করেছে। তবে বাংলাদেশের ক্রেতারা এই দামের পুরো সুফল নিতে পারেননি। কারণ, দেশের অর্থনৈতিক সংকট।
সংকটে ডলারের দাম ২৭ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় পণ্য আমদানিতে টাকায় খরচ সেভাবে কমেনি। সে জন্য খুচরায় গত বছরের তুলনায় দু-একটি বাদে বেশির ভাগ পণ্যের দাম এখনো বেশি।
আবারও বিশ্বব্যাংকের শরণাপন্ন হওয়া যাক। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ আমদানি করে এমন নিত্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে পাম তেলের দাম। টনপ্রতি এই দাম কমেছে ৭৭৫ ডলার বা ৪৪ শতাংশ। যুদ্ধের পর মার্চ মাসে যে পাম তেলের দাম উঠেছিল ১ হাজার ৭৭৬ ডলার, তা জানুয়ারি মাসে বেচাকেনা হয়েছে ৯৪২ ডলারে। দাম কমার মিছিলে আছে সয়াবিন তেলও। গেল মে মাসে প্রতি টন সয়াবিন তেল বেচাকেনা হয়েছিল ১ হাজার ৯৬৩ ডলারে। জানুয়ারি মাসে তা ১ হাজার ৩৫১ ডলারে বেচাকেনা হয়। তাতে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম টনপ্রতি কমল ৬১১ ডলার বা ৩১ শতাংশ। একইভাবে উচ্চ আমিষযুক্ত গম কিংবা সয়াবিন বীজের দামও কমেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অনেক পণ্যের দাম ৬৩ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিলেও চিনির ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি। বিশ্ববাজারে চিনির দামের রেকর্ড এখনো ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসের দখলে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, সেবার প্রতি কেজি চিনির দাম উঠেছিল ১ ডলার ২৪ সেন্টে। চিনির আকাশছোঁয়া দাম নিয়ে ১৯৭৪ সালের ১৫ নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস প্রধান শিরোনাম করেছিল। অবশ্য যুদ্ধবিগ্রহের জন্য সে সময় দাম এত বাড়েনি। বিশ্ববাজার থেকে রাশিয়া ও আরব দেশগুলোর চিনি কেনার গুজব এবং ইউরোপে হলুদ ভাইরাসের আক্রমণে ফসলের ক্ষতি হওয়ার প্রভাবে বাজার অস্থির হয়ে উঠেছিল সে সময়। রেকর্ড না ভাঙলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর গত বছরের এপ্রিলে বিশ্ববাজারে চিনির দাম প্রতি টন ৪৩৩ ডলারে উঠেছিল। জানুয়ারি মাসের হিসাবে এখন অবশ্য তা কমে ৪২০ ডলারে নেমেছে।
গত বছরের শেষের দিকে এসে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমে যাওয়ার বড় কারণ ছিল উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে খাদ্যশস্য সরবরাহে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় কূটনৈতিক চুক্তি। এই চুক্তির ফলে রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে গম আমদানি বেড়েছে। তবে যুদ্ধের আগে-পরে ভারতের গমের বাজার খোলা থাকায় বাংলাদেশে এই পণ্যটির দামে সেভাবে প্রভাব পড়েনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আড়াই মাসের মাথায় গত বছরের মে মাসে ভারত গম রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করে। এ কারণেই মূলত বাংলাদেশেও গমের দামে প্রভাব পড়তে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের হিসাবে, চলতি মৌসুমে বিশ্বে গমের উৎপাদন বাড়ার আভাস রয়েছে।
কৃষ্ণসাগর থেকে শস্য রপ্তানির চুক্তির বর্ধিত মেয়াদ শেষ হবে মার্চের মাঝামাঝি। চুক্তির মেয়াদ যদি আরও বাড়ানো হয়, তাহলে গমের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা কম। আবার আর্জেন্টিনায় খরার কারণে সয়াবিনের উৎপাদন কমার শঙ্কা রয়েছে। সেটি হলে প্রভাব পড়বে সয়াবিন তেলের দামে।
পণ্যবাজার বিশ্লেষক আসির হক প্রথম আলোকে বলেন, যুদ্ধের পর এখন বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। তবে আর্জেন্টিনায় চলমান খরা সামনে সয়াবিন তেলের দামে প্রভাব ফেলতে পারে। খরা যদি বিস্তৃত হয়, তাহলে ফলন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরবরাহ কমে দামের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে।
বিশ্বব্যাংক গত মাসে ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও চীনে প্রবৃদ্ধির হার কমায় বিশ্ব অর্থনীতি আরও খারাপ হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। মন্দা হলে বিশ্বে পণ্যের চাহিদা কমে যায়। তার প্রভাব পড়ে পণ্যের দামে। অর্থাৎ যুদ্ধ পণ্যবাজার অস্থির করলেও মন্দায় উত্তাপ কমিয়ে দিতে পারে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর নিত্যপণ্য আমদানি বাড়ছে। কারণ, দেশে উৎপাদিত পণ্য দিয়ে চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। গত বছর নিত্যপণ্য আমদানিতে ব্যয় প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। নিত্যপণ্যের মধ্যে প্রধান ছয়টি পণ্য আমদানিতেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে। এই ছয়টি পণ্য হলো গম, চিনি, সয়াবিন তেল, পাম তেল, ডাল ও সয়াবিন তেলের কাঁচামাল সয়াবীজ। বিশ্ববাজার স্থিতিশীল থাকলে এই ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব। তাতে কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলতে পারে ক্রেতাদের।
লেখা শেষ করার আগে বৈশ্বিক পণ্য বেচাকেনার শেয়ারবাজারের (কমোডিটি এক্সচেঞ্জ) সর্বশেষ লেনদেনে চোখ বুলিয়ে আসা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বোর্ড অব ট্রেড বা সিবিওটিতে সপ্তাহের শেষ দিন শুক্রবারের বেচাকেনায় ভুট্টা, সয়াকেক আর চাল ছাড়া তেল, গম, চিনির মতো নিত্যপণ্যের সব কটির দামই ছিল কমতির দিকে। এক দিনে সবচেয়ে বেশি কমেছে সয়াবিন তেলের দাম। সিবিওটির ওয়েবসাইটে ৩ শতাংশ দাম কমার সংখ্যাটি লাল রঙে রাঙানো। উৎসবের রং লাল আমদানিকারক হিসেবে বাংলাদেশের ক্রেতাদের জন্য কিছুটা স্বস্তির।
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন
Leave a Reply